ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে

প্রকাশিত: ১:৫৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৪, ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে

সিলেট স্টারঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হলের কক্ষে অস্ত্র ও মাদক রাখা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধর, হামলা ও যৌন হয়রানির মতো অপরাধের হার বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে এসব অপরাধের দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে ৫২ জন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালে বহিষ্কৃত হন ২৪ শিক্ষার্থী। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ১০ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়।

বহিষ্কৃতদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১৯ সালে পাঁচজন, ২০২০ সালে ১৭ জন, ২০২১ সালে তিনজন এবং ২০২২ সালে তিনজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে একজনকে স্থায়ী বহিষ্কার, ৩৩ জনকে সাময়িক, ছয়জনকে ছয় মাসের জন্য, ১০ জনকে এক বছরের জন্য, দুজনকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

এঁদের মধ্যে প্রথম বর্ষের ২২ জন, দ্বিতীয় বর্ষের ১৪ জন এবং অন্যরা অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

দুই মাসে ১০ জন বহিষ্কৃত

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবাসিক হলে আটকে রেখে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মারামারি এবং শতবর্ষ মনুমেন্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করায় ১০ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারধরের মতো অপরাধের হার বেশি। পাঁচ বছরে ৫২ জনের মধ্যে ৪৩ জনকে এবং চলতি বছরে ১০ জনের মধ্যে ৯ জনকে এসব অপরাধের দায়ে বহিষ্কার করা হয়।

গত পাঁচ বছরে বহিষ্কৃত ৫২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ জনই ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অপরাধ সংঘটনের সময় ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদ ছিল ১৩ জনের, দুজন সাবেক নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ২৫ জন যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে ২০১৯ সালের অক্টোবরে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১২১ নম্বর কক্ষে পিস্তল, গুলি, দেশীয় ধারালো অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও বিভিন্ন অবৈধ জিনিস রাখার ঘটনায় চারজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা আর দুজন সাবেক নেতা ছিলেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাকচালকের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের দুজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

তাঁরা হল শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একই বছর রমনা কালীমন্দির গেটের ভেতরে মারামারি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিভিন্ন হলের দ্বিতীয় বর্ষের ১৩ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাঁরাও ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন।

২০২১ সালে ছাত্রীদের সামনাসামনি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যৌন হয়রানির অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান হল কমিটির পদেও তিনি আছেন। একই বছর চাঁদাবাজির অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থীকে। তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক ছিলেন।

২০২২ সালের অক্টোবরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে নারী শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় মাস্টারদা সূর্য সেন হলের এক শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিখা চিরন্তন গেটে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় দুজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাঁদের একজন হল শাখা নেতা এবং আরেকজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। একই বছরে কাভার্ড ভ্যান আটকে চাঁদাবাজির ঘটনায় তিনজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা বিজয় একাত্তর হল শাখা কমিটির কর্মী ছিলেন। একই বছর প্রলয় গ্যাংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৯ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁদের ১২ জন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

চলতি বছর শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসে ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে আটকে রেখে চাঁদা দাবি করায় চারজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। চারজনই ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন। শিখা চিরন্তনে মারধর ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় চারজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা হল শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এসব ঘটনায় ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রভাব রয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ছাত্ররাজনীতির কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। একই সঙ্গে আবাসনসংকট, ছাত্রসংসদের অনুপস্থিতি, জবাবদিহিমূলক ছাত্ররাজনীতি প্রত্যাশিত মাত্রায় না থাকায় এগুলো কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে।’

সাদ্দাম বলেন, ‘বিদ্যমান বাস্তবতায় আমরা যেমন অপরাধীদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেব তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে যদি একাডেমিক, নান্দনিক এবং আরো বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব করতে পারি তাহলে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতার ঘটনা একেবারেই থাকবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘এই ধরনের অপরাধগুলো শুধু ঢাবিতে নয়, সব জায়গায় বাড়ছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে মানসম্মত জায়গায় পৌঁছেছে, সেখান থেকে এই অপরাধের পরিসংখ্যান পীড়াদায়ক।’

এসব অপরাধের পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, অনেক ভালো ভালো ছাত্ররাজনীতিবিদ আছেন। কিন্তু কিছু সময় দেখা যায়, ছাত্ররাজনীতি করছেন এমন কিছু কিছু ব্যক্তি পড়াশোনার বাইরে গিয়ে ‘পাওয়ার পলিটিকস’ করেন। তাঁরা অনেক সময় জুনিয়র শিক্ষার্থীদের অপব্যবহার করে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে হতাশা থাকে। তাঁরা অর্থনৈতিক-সামাজিক টানাপড়েন, ঢাকার জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়ে যান।

বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ হয় না। ছোট ছোট বিষয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে থাকে। এর জন্য অনেক সময় দেখা যায়, একজন আরেকজনকে পেটাচ্ছেন।

সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘আমরা এখন শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ম্যানুয়াল তৈরি করছি। শিক্ষার্থীরা যেন বিপথগামী না হয় সে জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবাটা আমরা দেব। সব ক্লাস প্রতিনিধি ও ছাত্র উপদেষ্টাকে এই ম্যানুয়ালের ওপর তিন দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কোনো শিক্ষার্থী যদি মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়, বিপথগামী হয় বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় তখন সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে, কথা বলবে এবং তাঁর ভবিষ্যতের চিন্তা-ভাবনা সে নিজেই যেন করতে পারে, সে জন্য আমরা ম্যানুয়ালটি তৈরি করছি। দুই মাসের মধ্যে ম্যানুয়ালটি হয়ে যেতে পারে।