হরতাল-অবরোধ থেকে সরে এলো বিএনপি

প্রকাশিত: ১২:০২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩, ২০২৪

হরতাল-অবরোধ থেকে সরে এলো বিএনপি

সিলেট স্টারঃ হরতাল-অবরোধ দিয়ে নির্বাচন ঠেকানোর সর্বাত্মক কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বিএনপি। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় পর্যালোচনা করে দলের নীতিনির্ধারকরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

কর্মসূচি নির্ধারণে গত রবিবার চার সাংগঠনিক বিভাগের কয়েক শ নেতা এবং দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। প্রায় চার ঘণ্টা বৈঠকের পর নতুন কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

সপ্তাহ খানেক আগে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভোটের এক সপ্তাহ আগ থেকে টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোও টানা কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিল।

বিএনপি নেতারা জানান, নতুন কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনা এবং সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য তাঁদের প্রভাবিত করেছে। সব দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে বিএনপি নির্বাচন ঠেকানোর চেয়ে ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, তিন কারণে তাঁদের কৌশলী হওয়া উচিত। প্রথমত, অভাবনীয় কিছু না ঘটলে নির্বাচন যে ঠেকানো যাবে না, সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছেন নেতারা। ফলে নির্বাচন ঠেকাতে এমন কর্মসূচি দিতে চায় না দলটি, যাতে ব্যর্থ হয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হন। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে দেশে ধ্বংসাত্মক নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হতে পারে।

ফলে নির্বাচনের পর বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া হতে পারে। তৃতীয়ত, নির্বাচনের পর কিছুদিন চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চায় বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির কঠোর প্রয়োগ ও নতুন নিষেধাজ্ঞা দিলে কর্মসূচি পালন করার মতো পরিবেশ ধরে রাখতে চলমান আন্দোলনের ইতি টানতে চাইছেন না তাঁরা।

এমন বাস্তবতায় বিএনপি ভোটদানে নিরুৎসাহ করতে আগামী তিন দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলীয় সূত্র জানায়, শুক্রবার কর্মসূচিতে বিরতি দিয়ে ভোটের আগের দিন শনিবার ও ভোটের দিন রবিবার হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা রাজপথে আছি, রাজপথে থাকব। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হবে। আমরা কখনো নাশকতায় জড়াইনি, অন্য কোনো পক্ষকে নাশকতা করার সুযোগ দিতে চাই না।’

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৪ দিন অবরোধ কর্মসূচি করে বিএনপি। এরপর ভোট ঠেকাতে জনগণকে ভোট বর্জনের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। যদিও অসহযোগ আন্দোলনের কার্যকারিতা নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জনগণকে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহ করতে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ১০ দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করে বিএনপি।

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে বিএনপির সন্দেহ !

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সারা দেশে তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁরা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের বাস্তবতা তুলে ধরেন। অনেকে বলেন, নেতাকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ কম। বেশির ভাগ নেতাকর্মী ঘরছাড়া, হয়রানিতে আছে তাঁদের পরিবার। এমন পরিস্থিতিতে ভোট ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ভোট ঠেকানোর কর্মসূচিও জোরালোভাবে পালিত হবে না।

এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। সেখানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য নিয়ে বিএনপি নেতারা সন্দেহ পোষণ করেন।

গত ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘আমরা খবর পাচ্ছি—নির্বাচনকে ঘিরে সব আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন গুপ্তহত্যার দিকে যাবে।’

স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি মনে করছে, ২৮ অক্টোবরের মতো সরকার আরেকটি ‘নীলনকশা’ তৈরি করছে। বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানো হতে পারে। হরতাল-অবরোধের মধ্যে সরকারি দলের নেতারা বাস-ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করেছে। এসব ঘটনায় বিএনপির ওপর দায় চাপানোর বিষয়টি দেশি-বিদেশিরা বিশ্বাস করেনি। এখন বড় ধরনের নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দলের তকমা দিতে চায় সরকার।

স্থায়ী কমিটির এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপি বিবৃতি পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ জানানো হয়।

বিবৃতিতে রিজভী বলেন, এই বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের গভীর ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার অংশ। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থনে আওয়ামী লীগ অপকর্ম করে অন্যের ঘাড়ে তার দায় চাপানোর রাজনীতির পুনরাবৃত্তির চক্রান্ত করছে। বিএনপি নিয়ে ওবায়দুল কাদের যে মন্তব্য করেছেন, তা ন্যক্কারজনক, নিন্দনীয় ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে। এই পরিস্থিতিতে কঠোর কর্মসূচি দিলে পুলিশ আরো কঠোর হবে। রাজপথ কর্মী শূন্য হয়ে পড়লে সামনের কর্মসূচি পালন কঠিন হবে।

ভোটার দিনটাই চ্যালেঞ্জ

আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের দিনটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এ দিন সরকারবিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটাররাও যাতে কেন্দ্রে না যায়, সে বিষয়ে জনমত তৈরিকে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে। চলমান গণসংযোগে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে দলের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেন, এবার ভোটারদের ওপর কেন্দ্রে যাওয়ার বেশ চাপ রয়েছে। এ জন্য ভোটারদের কেন্দ্রে না যেতেও কিছুটা সাহসী ও কৌশলী হতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ভোট নিয়ে অনেক প্রার্থীর মাঝেই কোনো আগ্রহ নেই। কে এমপি হবে, তা তো চূড়ান্ত হয়ে আছে। ৭ জানুয়ারি শুধু ঘোষণা হবে। ফলে সচেতন কোনো মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।

তিন দিন বাড়ল গণসংযোগভোট বর্জনে দেশব্যাপী চলমান গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি আরো তিন দিন বাড়িয়েছে বিএনপি। আজ মঙ্গলবার থেকে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।গতকাল বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কর্মসূচি বাড়ানোর ঘোষণা দেন।গত ২১ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত ১০ দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।