শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থান কই?

প্রকাশিত: ৮:২৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৭, ২০২২

শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থান কই?

:: জুঁই ইসলাম ::
পশুরা স্বপ্ন দেখে না, মানুষ স্বপ্ন দেখে, মানুষ স্বপ্নকে নিয়ে লালন-পালন করে আবার সেই লালিত স্বপ্নকে বান্তবরূপ দিতে গিয়ে হাজার ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকারও করে বিভিন্ন সময় জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশে লক্ষ জনতা স্বপ্ন পূরণের আশায় পাহাড় সমান কষ্টকে আলিঙ্গন করে বেঁচে থাকে শুধু মাত্র কিছু পাওয়ার আশায়। আমাদের দেশে শিশুদের প্রাথমিক বর্ণমালা শিখানোর সময়ই প্রবাদ বাক্যও শিখানো হয়- ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি, ঘোড়া চড়ে সে।’ এই যে একটি চিরন্তন বাণী সে বাণীর সাথে পরিচিত নয় এমন কোন শিক্ষার্থী আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সকল শিশুমনে বীজ জাগিয়ে দেওয়া হয় তুমি লেখা পড়া করলে গাড়ি চড়বে, কিংবা ধর তোমার বাড়ি-গাড়ি থাকবে, তুমি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারবে, তোমার আগামিতে সুন্দর একটা নীড় হবে যেখানে তোমার পরিবার নিয়ে সুখে- শান্তিতে থাকবে কিংবা শিক্ষিত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে তুমি কিছু অবদান রাখবে ইত্যাদি ।

সেই স্বপ্ন পূরনের আশায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিজেকে গড়ে তোলার জন্য অনেক ক্ষেত্রে মরিয়া হয়ে উঠে। মানুষ হতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে কোমল কামনা. বাসনার জায়গা তৈরি হয় সেই শিশুকাল থেকেই। এই স্বপ্ন যে শুধু শিক্ষার্থীরা করেন তা-না বাবা-মায়েরাও সহায় সম্বল যা থাকে সব ব্যয় করেন অনেক সময় সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল গড়ার চিন্তায়। শেষ বয়সে সন্তানকে ভালো একটি অবস্থায় দেখে যেতে চান প্রতিটি বাবা-মা।

একজন শিক্ষার্থী যখন লেখা পড়া শেষে কোনো চাকুরীর সন্ধান করেন তখন চাকুরী কই ? আমি গেল ক‘মাস থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে ভাবছি। বিভিন্নভাবে দেশের বেকারত্ব নিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে আজকের এ লেখাটি বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

আমার-ই খুব কাছের কিংবা পরিচিত কয়েকজন ভাই, বোন আছেন যারা এম.এ পাশ কিন্তু কোন চাকুরী করেন না, করেন না বলাটা হয়তো ভুল চাকুরী পেলে তো করবেন। সিলেটে চাকুরী কই ? লেখাপড়া শেষ করে কোথায় যে চাকুরীর এ্যাপ্লাই করবেন একজন শিক্ষার্থী তারও কোন সুযোগ নেই। বেকাররা প্রতিদিন পেপার পড়েন কিংবা অনলাইনে চোখ রাখেন, দেখেন কোথাও কোনো চাকরির নিয়োগে সন্ধান পাওয়া যায় কি-না মাঝে মাঝে দু’একটা বিজ্ঞপ্তি মিললেও দেখা যায় একটা পোষ্টের জন্য কমপক্ষে ৫০জন কিংবা তার উপর এ্যাপ্লাই করেছেন। একটা চাকরির এ্যাপ্লাই করতে যে কত কষ্টও হয় বেকারদের সাথে টাকাও খরচ লাগে ব্যাংক ড্রাফটে কিংবা ফরম কিনতে এবং যাতায়াত খরচ, তারপরও অনেক সময় দেখা যায় কর্তৃপক্ষ অভিজ্ঞতা চান আরও কত কি ? যেখানে একজন বেকার দিনের পর দিন চাকুরির সন্ধানে লিপ্ত সেখানে অভিজ্ঞতা কই পাবেন তারা ? একজন বেকার আমাকে হেসে হেসে বলেই দিলেন সেদিন, আচ্ছা আপা অভিজ্ঞতা কই পাওয়া যায়, কোন মার্কেটে পাওয়া যায় ? কিংবা কার কাছে ধার পাওয়া যায় ? এই বোনের মত হাজার বেকারের হয়ত আজ এই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন বোনটির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি।

প্রতিদিনই বেকাররা চাকুরির সন্ধান করে থাকেন বিভিন্ন পন্থায়। একজন বেকার চাকরি খুঁজতে খুঁজতে যখন কিছইু মনের মত জোটাতে পারেন না তখন বিরক্ত আর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে চাকুরী খোঁজ খবর ছেড়েই দেন।

আমাদের সিলেটে মুরারি চাঁদ কলেজ, মদনমোহন কলেজ, সিলেট সরকারী কলেজ ও সিলেট সরকারী মহিলা কলেজ থেকে প্রতিবছরই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ করে যারা বের হচ্ছেন তাদের জন্য সিলেট কি কোন চাকুরীর ব্যবস্থা আছে ? কয়েকটা প্রাইভেট ব্যাংক, প্রাইভেট কলেজ, কিংবা স্কুল ছাড়া আর তো তেমন কিছুই নেই যেখানে একজন বেকার চাকরির সন্ধান করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের তুলনায় চাকরীর ক্ষেত্রটি সিলেটে খুবই নগণ্য যার কারণে দিন দিন সিলেট বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সিলেট আগের তুলনায় শিক্ষিতের হার বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে বেকারের সংখ্যাও। এ নিয়ে আমাদের সিলেটের উর্ধ্বতন ব্যক্তিরা মনে হয় না যে উদ্ধিগ্ন । অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আশানুরূপ কোন চাকরি না পেয়ে বিদেশ চলে যায়, এদের মেধাও কোন কাজে লাগে না দেশের বা দশের। যা কোনভাবে কাম্য নয়। আমাদের যুবশক্তির মেধাকে মূল্যায়নের সুযোগ তৈরির চিন্তা করতে হবে, না হয় দিন দিন বেকার বাড়বেই সিলেটের ঘরে ঘরে। একটা সময় ছিল সিলেট একটা এলাকায় এম.এ পাশ একজন লোক খুঁজে পাওয়া যেত না কিন্তু দিন বদলের পালাতে এখন ঘরে ঘরে এম.এ পাশ শিক্ষার্থী মিলে কিন্তু সেই তুলনায় চাকরি নেই।

আবার অনেক সময় দেখা যায় বিশেষ করে সিলেটের মেয়েগুলা সিলেটের বাইরে চাকুরী করতে অনিহা প্রকাশ করেন, কারণ অনেক পরিবার মেয়েদের বাইরে দিতে চান না আর সিলেটে কোন চাকুরি খুঁজ না পাওয়াতে বেকারের খাতায় নাম লিখান অনেকেই অনেক সময়। এমনও দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থী সঠিক সময়ে চাকরি না পেয়ে হতাশায় নিম্মজিত হয়ে জীবনের রোমান্সের মুহূর্তগুলোও মিস করেন, যেমন লেখাপড়া শেষ করে যখন অনেক সময় একটা চাকুরীই জোটাতে পারেন না জীবনে সেখানে বিয়ে করে বউ জোটানো তো অনেক কঠিন কাজ পুরুষ বেকারদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে বেকারের মূল কারণ মেয়েদের অগ্রাধিকার দেওয়া। একজন পুরুষ বেকার থাকলে তাকে কোনো নারী বিয়ে করবে না কিন্তু একজন নারী বেকার থাকলে তাকে যে কেউ বিয়ে করবে। জীবনের স্বপ্নগুলো মরে ভুতই হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে চাকুরী না পাওয়ার কারণে অনেক যুবকের জীবনে।

চাকরির ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী, পুরুষের বৈষম্য। একজন পুরুষ বি.এ পাশ না করলে দেখা যায় সরকারী প্রাইমারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না অথচ নারী এইচ.এ.সি পাশ করলেই অংশ নিতে পারেন। দেখা যায় একজন পুরুষ বি.এ পাশ করতে করতে একজন নারী তিন-থেকে চার বার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন যেখানে পুরুষরা পাচ্ছেন না। কিন্তু একটা পরিবারে একজন পুরুষের হাল ধরতে হয় মেয়েদের থেকে বেশি।

এইভাবে সিলেটসহ সারা দেশেই দিন দিন দেশে যত বেশি পাশের হার বাড়ছে তত বেশি বেকার সমস্যা হু হু করে বাড়ছে এবং এতে কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে প্রতিনিয়ত। প্রতি বছর যে পরিমাণ পাশ করছে জাতীয় কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই পরিমাণ কি কর্মসংস্থান আমাদের আছে ? বেকার সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্র নায়করা মনে হয় না চিন্তিত যতটা না শিক্ষার পাঠ্যসূচী পরিবর্তন কিংবা পাশের হার নিয়ে ভাবেন। আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার সমস্যায় জর্জরিত বর্তমানে। কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক বেকার যুবক-যুবতীরা পথভ্রষ্ট হয়ে বিপথগামী হচ্ছেন। অনেকে আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সেদিন একটা জরিপে দেখলাম- বিশ্বে বেকারত্বের মধ্যে বাংলাদেশ ১২ তম। বছরে ২০ লাখ নতুন মুখ শ্রমশক্তিতে প্রতি ১০০ স্নাতকের ৪৭ জন বেকার, চিকিৎসক-প্রকৌশলী ১৪.২৭ শতাংশ, কলেজ- গ্র্যাজুয়েট ৬৬ শতাংশ পুরুষ, ৭৭ শতাংশ নারী বেকার। পড়াশোনা শেষে ৩ বছর ধরে চাকরির সন্ধানে ৪৬ শতাংশ আছেন কলেজ গ্র্যাজুয়েট। এই হল বর্তমান বাংলাদেশের বেকারদের তথ্য।

যুব মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে দেশে বর্তমানে ১৮ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত যুব পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। আগামী বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় পাঁচ কোটিতে। ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। তার মধ্যে শিক্ষিত বেকার হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ। অপরদিকে দেশে পরিবারের সংখ্যা সোয়া পাঁচ কোটি। প্রত্যেক পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দিতে হলে সোয়া পাঁচ কোটি লোককে চাকুরি দিতে হয় যেটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুবই কঠিন। দিন দিন বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বল্প শিক্ষিতের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত কর্মহীনের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে ছোট হয়ে আসছে কর্মসংস্থানের পরিধি। অনেক শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও ঘুরছেন বেকারত্ব নিয়ে। কারণ একটাই শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়েনি।

আমাদের বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল প্রতিটি পরিবারে কমপক্ষে একটি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া কিন্তু আমরা দিনের পর দিন সেই অনুপাতে আশানুরূপ কোন ফল পাচ্ছি না। ফলে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্য ২ কোটি ৪৪ লক্ষ যা সত্যি আমাকে বিস্মিত করেছে এই জরিপটি। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে বেকারত্বের হার। বেকারত্বের এই সমস্যা-সংকট দেশে একদিনে তৈরি হয়নি। এই মুহূর্তে বেকারত্ব নিরসন যেমন অপরিহার্য, তেমনি ভবিষ্যতে বেকারত্ব কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তার নিরিখে আগাম ব্যবস্থা গ্রহন খুবই জরুরি। পরিকল্পনা কমিশন ও জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপির যৌথ গবেষণা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে কর্মক্ষম যুবক-যুবতীর সংখ্যাই দাঁড়াবে সাড়ে তিন কোটি। বেকারত্বের হার বর্তমান অবস্থায় রাখতে হলে এ সময়ের মধ্যে এক কোটির উপর যুবক-যুবতীকে চাকুরি দিতে হবে। তবে কারিগরি ও বিশেষায়িত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের চাকরির বাজারে ভালো চাহিদা আছে, যা সাধারণ শিক্ষাধারীর ক্ষেত্রে নেই। যেমন- বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে কলেজ থেকে পাশ করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ আমাদের দেশে।

বেকাত্বের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয়করণের মনোবৃত্তি পরিহার করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বেকাত্বের হাত থেকে দেশকে সুরক্ষার চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষার্থীদের জীবনের সৎ ও সুন্দর স্বপ্নগুলো যেন মরুভূমি প্রান্তর না হয় সেই জন্য রাষ্ট্রীয় নেতাদের সচেতন হতে হবে, এদের নিয়ে ভাবতে হবে। অন্যথায় বেকাররা দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে যা বলাই বাহুল্য।
লেখক : কলামিস্ট।