কম বয়সে হৃদরোগ-বাড়ছে মৃত্যু

প্রকাশিত: ২:৩২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২

কম বয়সে হৃদরোগ-বাড়ছে মৃত্যু

এম বাংলা প্রতিবেদকঃদেশে কম বয়সী হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় এই হার ১৭ গুণ বেশি। বাড়ছে অল্প বয়সে মৃত্যুও। অল্প বয়সে ধূমপান, মদ্যপান, কোলেস্টেরল ও চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ডায়াবেটিস হওয়া—এর অন্যতম কারণ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণার ফলাফলে এ তথ্য জানা যায়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের আরেক গবেষণার ফলাফলে উল্লেখ করা হয়, অত্যধিক লবণযুক্ত প্যাকেটজাত খাবারে হৃদরোগী বাড়ছে।বিশ্ব হার্ট দিবস আজ। ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দিনটি বাংলাদেশেও উদযাপন করা হবে দিবসটি।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে হৃদরোগে। এর অন্যতম প্রধান কারণ তামাক, উন্নত আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস, অসচেতনতা ও খাদ্যে অতিরিক্ত লবণের ব্যবহার। ফলে হৃদরোগ শুধু বড়দের নয়, শিশু-কিশোরদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে ১৯ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। এই রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যায় দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষ, যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক।

গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। দেশে তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে বছরে এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ (তিন কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে, যা হৃদরোগ পরিস্থিতিকে আরো উদ্বেগজনক করে তুলছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গবেষণার ফল অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বের তুলনায় এই হার ১৭ গুণ বেশি। এর অন্যতম কারণ অল্প বয়সে ধূমপান, মদ্যপান, জাংক ফুড, লাইফস্টাইল, অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হওয়া।

এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সাধারণত ৬০ বছর বয়স থেকে প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়; কিন্তু আমাদের দেশে ৩৫ বছরের কম বয়সী অসংখ্য ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। ফলে অপরিণত বয়সে মৃত্যুও বাড়ছে।

বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, তামাকজনিত হৃদরোগ ঝুঁকি হ্রাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইন সংশোধনের পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী। তামাক কম্পানির অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না নিয়ে খসড়াটি দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে (৬১ শতাংশ) নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ পাওয়া গেছে। অত্যধিক লবণ গ্রহণের ফলে হৃদরোগী বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ পরিচালিত ‘অ্যাসেসমেন্ট অব সল্ট কন্টেন্ট অ্যান্ড লেবেল কমপ্লায়েন্স অব কমনলি কনজিউমড প্রোসেসড প্যাকেজড ফুডস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।যুক্তরাষ্ট্রের রিজলভ টু সেভ লাইভস সহায়তায় সম্পাদিত গবেষণাটির ফল গতকাল বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে একটি সেমিনারে প্রকাশ করা হয়।

গবেষণায় প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে সর্বোচ্চ ৭৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণকে নিরাপদ মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, বাজারে বহুল প্রচলিত ৬১ শতাংশ বিস্কুট, চিপস, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ঝালমুড়ি, আচার, চাটনি ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ রয়েছে। আর ৩৪ শতাংশ খাবারে নিরাপদ মাত্রার দ্বিগুণ, অর্থাত্ ১.৫ গ্রামের বেশি লবণ পাওয়া গেছে।

বহুল প্রচলিত চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ ও ঝালমুড়ির কোনোটিতেই নির্ধারিত মাত্রার লবণ পাওয়া যায়নি, বরং এগুলোতে দ্বিগুণের বেশি লবণ রয়েছে। একইভাবে আচার ও চাটনির ৮৩ শতাংশ, চিপসের ৬৩ শতাংশ এবং ডাল-বুট ভাজার ৬০ শতাংশে দ্বিগুণ লবণ রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। চিপস, ডাল-বুটের একটিতেও নির্ধারিত মাত্রার লবণ নেই।

গবেষণাটিতে বাজারে বহুল প্রচলিত ১০৫টি ব্র্যান্ডের চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ঝালমুড়ি, লজেন্স, আচার-চাটনি, চিপস, ডাল-বুট, সস, বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, কোমল পানীয় ও ফ্রুট ড্রিংকসের নমুনা পরীক্ষা করে এই ফল পাওয়া গেছে।মূলত দেশে সরকারিভাবে প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণের সর্বোচ্চ কোনো সীমা নির্ধারণ করা নেই। ফলে কম্পানিগুলো তাদের পণ্যে ইচ্ছামতো লবণ যোগ করে। যদিও মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০১৭ অনুসারে, প্রক্রিয়াজাত খাবারে বিদ্যমান লবণের পরিমাণ মোড়কের লেবেলে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু গবেষণায় প্রায় অর্ধেক (৪৪ শতাংশ) খাবারে মোড়কে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি লবণ পাওয়া গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষই এজাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। গড়ে একজন ব্যক্তি সপ্তাহে ১৫ বার, অর্থাত্ দিনে দুইবারের বেশি এসব খাবার গ্রহণ করে।

বিএসএমএমইউ হাসপাতালে সহকারি অধ্যাপক ডা. এস এম ইয়ার ই মাহাবুব বলেন, গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন তরুণের মধ্যে একজন হৃদরোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ৫০ শতাংশ রোগী হাসপাতালে আসার আগের মৃত্যুবরণ করে। অনেক সময় আসার পরে দেখা যায়, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই বা রোগী অনেক দেরি করে আসছে। ফলে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।যখন বুক ব্যথা বা ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো, শ্বাস নিতে সমস্যা, ক্লান্তি, গ্যাস হওয়া, ঘেমে যাওয়া তখন অবহেলা না করে অতি শিগগির নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রথমে প্রতিরোধ জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। ঝুঁকি এড়াতে পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম করা সঙ্গে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবারও খেতে হবে। জাংক ফুড বা চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাসের কারণে কম বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হয়। তাই এসব পরিহার করতে হবে।