তাদের বিদায়ে শূন্য সিলেট

প্রকাশিত: ২:৩৮ অপরাহ্ণ, মে ৮, ২০২২

তাদের বিদায়ে শূন্য সিলেট

ওয়েছ খছরু:
ওদের চোখে এক সময় স্বপ্ন দেখতো সিলেটের মানুষ। আশা ভরসারস্থল ছিলেন তারা। দুর্দিন ও দুর্বিপাকে ছুটে যেতেন তাদের কাছে। মমতায় আগলেও রাখতেন তারা। মানুষকে ভালোবাসতেন। সিলেটকেই এগিয়ে রাখতেন সর্বাগ্রে। জাতীয় রাজনীতিতেও তাদের ছিল সমান দাপট। উন্নয়নেও ছিলেন সিলেটের অন্তঃপ্রাণ জনপ্রতিনিধি।
সুখে, দুঃখে মিলেমিশে হয়ে যেতেন একাকার। আজ তারা নেই মাত্র দুই ব্যবধানেই একে একে ঝরে গেলেন সিলেটের এই নক্ষত্ররা। তাদের প্রস্থান নিয়ে আফসোসেরও অন্ত নেই। শূন্যস্থান পূরণ হবে না, হচ্ছেও না। করোনার দুই বছরের লড়াই। হেরেছেন অনেকেই। বেঁচে থাকার সংখ্যা বেশি।
দুই বছর পর এবারের সিলেটের ঈদ ছিল প্রাণখোলা। ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোলাহল হয়েছে। প্রাণ খুলে ঈদ উদ্‌যাপন করেছেন সিলেটের মানুষ। দুই বছর পরের এই ঈদে নেই প্রিয় মুখগুলো। অথচ এদের ঘিরেই গত দুই দশক সিলেট ছিল সরগরম। রাজনীতিতেও ছিল বৈচিত্র্যতা। সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি ভরা। এখন অনেকেরই কাছে মনে হচ্ছে এলোমেলো সিলেট। নতুনরা দায়িত্ব নিচ্ছেন, নেবেনও। একটু সময় দিতে হবে। এই সময়ে ওদের শূন্যস্থানে কেবল ওদেরই বসবাস।
গত দুই বছরে সিলেটবাসী হারিয়েছে প্রিয় ৫ স্বজনকে। যারা সিলেটের মানুষের ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু, উন্নয়নে ছিলেন অগ্রদূত। এই ৫ জন সামাজিকভাবে সিলেটের মানুষের ছিলেন কাছাকাছি। এরা হলেন- সাবেক অর্থমন্ত্রী, সিলেট-১ আসনের দুই বারের এমপি আবুল মাল আব্দুল মুহিত, সিলেটের জনদরদী সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ, সিলেট-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, সিলেট-৪ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক দিলদার হোসেন সেলিম ও বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এমএ হক।
তৃপ্ত জীবন নিয়ে ঈদের আগে চলে গেলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। সিলেটের জন্য এক অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন। উন্নয়নও করেছেন। নগর এবং নগরের বাইরেও ছিল তার উন্নয়নের বিস্তৃতি। প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের উত্তরসূরি হিসেবে তিনি আলোকিত সিলেট গড়তে নিরলস কাজ করে গেছেন। তার হাত ধরে সিলেট পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সিলেটের সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি, সামাজিক অঙ্গনে সমানভাবে দৃপ্তি ছড়িয়েছেন প্রয়াত মুহিত। এ কারণে তার মৃত্যুতে এখনো কাঁদছে সিলেটের মানুষ।
কথা ছিল এবার ঈদে সিলেট আসবেন। নিজ বাড়ি নগরীর হাফিজ কমপ্লেক্সে সবাইকে নিয়ে ঈদ উদ্‌যাপন করবেন। কিন্তু ঈদের দু’দিন আগে সিলেটে এলেন ঠিকই। জীবিত নয়, লাশ হয়ে। নিজ থেকে অবসরে চলে গিয়েছিলেন মুহিত। জীবনের শেষ বয়সে এসে লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে রমজানের শেষদিকে এসে জটিল হয় শারীরিক পরিস্থিতি।
সিলেটের মানুষের কাছে এখনো মেয়র হিসেবেই পরিচিত বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। মহামারি করোনা তাকে সিলেটের মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিলো চিরতরে। তার মৃত্যুতে সিলেটে শূন্যতা বিরাজ করছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের দুই বারের মেয়র ও পৌরসভার শেষ বারের চেয়ারম্যান বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দলের জন্য তিনি যেমনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তেমনি সিলেটের মানুষের জন্য তিনি ছিলেন একজন সমাজ দরদী মানুষ। ২০২০ সালের ১৫ই জুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান কামরান।
২০১৩ সাল থেকে সিলেট সিটি করপোরেশনের মসনদের বাইরে ছিলেন কামরান। তবু তাকে ‘মেয়র সাব’ হিসেবে ডাকতেন সিলেটের মানুষ। কারণে, অকারণে তার কাছেই ছুটে যেতেন মানুষ। কামরানের ড্রয়িং রুম সবসময়ই থাকতো সরগরম। করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কামরান নিজ উদ্যোগে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশেষ করে খাদ্য সংকটে প্রতিদিনই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে খাবার সরবরাহ করতেন।
এছাড়া, চিকিৎসা ও করোনার প্রতিরোধ সামগ্রীও পৌঁছে দিতেন মানুষের কাছে। করোনার কারণে পরিবার থেকে ছিল কড়াকড়ি। বড় ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু সব সময় আইসোলেটেড করে রাখতে চেয়েছিলেন। পারিবারিক সব বাধা ভেঙে মানুষের প্রয়োজনে ছুটেছিলেন কামরান। অবশেষে তিনি নিজেই হয়ে পড়লেন করোনা আক্রান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাকে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কামরান।
সিলেটের রাজনীতিতে সামাজিক নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সিলেট-৩ আসনের পরপর তিন বারের এমপি মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। গত বছরের ১১ই মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। করোনাকালে নিজের এবং তার পরিবারের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি খাবার বিতরণ করেন তার নির্বাচনী এলাকা সিলেট-৩ আসনে। সব বাধা উপেক্ষা করে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে তিনি দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ এলাকায় এলাকায় ছুটে গেছেন। দক্ষিণ সুরমার সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে আইসোলেশন সেন্টার করতে তিনি প্রচেষ্টা চালান। এতে সফলও হন। এক পর্যায়ে এসে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে ঢাকার ফেরার পথে বিমানেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সিলেটের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও অগ্রজ নেতা ছিলেন মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। সুখে, দুঃখে সব সময় মানুষের কাছাকাছি থাকতেন।
সিলেট-৪ আসনের সাবেক এমপি, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দিলদার হোসেন সেলিমও সামাজিক নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজ এলাকার মানুষের কাছে তিনিও ছিলেন ভালোবাসার প্রতীক। দলের জন্য ছিলেন আস্থাভাজন এক নেতা। বিশেষ করে বিএনপিদলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। ক’বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন দিলদার হোসেন সেলিম। করোনাকালেও শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। নানা অসুখ, বিসুখে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৫ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সিলেটে ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ ছিলেন দিলদার হোসেন সেলিম। তিনি সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দিলদার হোসেন সেলিমের মৃত্যুতে এখনো কাঁদছে সিলেট-৪ আসনের মানুষ। সিলেটে পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এমএ হক। সিলেটের দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে শেষ আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। সামাজিক রাজনীতিবিদ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন তিনি। একজন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
জনগণের প্রতিনিধি না হলেও এমএ হকের কাছে সিলেটের সর্বস্তরের মানুষজন ছুটে যেতো। তিনিও তাদের আপনজন হিসেবে গ্রহণ করতেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের আস্থাভাজন নেতা হিসেবে বিএনপি’র জমানায় সিলেটের উন্নয়নে অনেক অবদান রাখেন। সাইফুর রহমানও তাকে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দলের জন্য একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা হিসেবে কাজ করে গেছেন। গেল কয়েক বছর বিএনপি’র রাজনীতিকে কেন্দ্র করে যত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সবকিছু সমাধান হয়েছিল এমএ হকের বাসায় বসেই। নিজ এলাকা বালাগঞ্জের মানুষের সুখে, দুঃখে পাশে থেকেছেন। করোনাকালেও তিনি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে ছুটে চলেছেন। ২০২০ সালের ৩রা এপ্রিল মারা যান এমএ হক। তার মৃত্যুতে সিলেট বিএনপিতে অপার শূন্যতা বিরাজ করছে।

এমএনআই/মানবজমিন