জাফলংয়ে উন্নয়নের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ১:৩৬ অপরাহ্ণ, মে ৭, ২০২২

জাফলংয়ে উন্নয়নের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি

নিউজ ডেস্ক: ‘প্রকৃতিকন্যা’ জাফলংয়ে পর্যটনের উন্নয়নের নামে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি হয়। সারাদেশের অন্য পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ ফি নেওয়া না হলেও সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ব্যতিক্রম।
এখানে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে পর্যটকদের কাছ থেকে পর্যটনের উন্নয়নের নামে চাঁদা নেওয়া হলেও দু’দিন আগে তা আলোচনায় আসে। গত বৃহস্পতিবার প্রশাসনের নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবকরা জাফলংয়ে বেড়াতে আসা নারী-পুরুষদের মারধরের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে পর্যটকদের মারধরের শিকার হওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়।
এরপর পর্যটকদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য নেওয়া বা স্বেচ্ছাসেবক পরিচয়ধারীদের ঘণ্টা হিসেবে মজুরি দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান জানিয়েছেন, জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন শুধু ফি নেওয়ার বিষয় বাস্তবায়ন করছে। উপজেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি বিষয়টিকে ‘চাঁদাবাজি’ বলতে অস্বীকার করে বলেন, এর আগে জাফলংকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে।
ফলে জাফলংয়ের পর্যটন উন্নয়নে বরাদ্দ এলেও তা ফেরত যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পর্যটকদের সুবিধার্থে জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাফলংয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে ১০ টাকা হারে প্রবেশমূল্য নেওয়া হয়। এ টাকা দিয়ে এলাকা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বেচ্ছাসেবকদের মজুরিসহ আগত পর্যটকদের বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়। সবুজে ঘেরা পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনা ও ছোট-বড় পাথর ডিঙিয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশির সৌন্দর্য দেখতে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের মানুষ জাফলংয়ে ভিড় করেন। সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর ওপর আছে ঝুলন্ত সেতু, যা দুটি পাহাড়কে যুক্ত করেছে। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।
পর্যটকের ভিড় সবচেয়ে বেশি থাকে সীমান্তের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকায় ডাউকি নদীতে। এমন উন্মুক্ত স্থানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছ থেকে উন্নয়নের জন্য ‘চাঁদা’ নেওয়ার সমালোচনা হচ্ছে। এই প্রবেশ টিকিট নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে বৃহস্পতিবার পর্যটকদের লাঠি দিয়ে মারধর করে স্বেচ্ছাসেবকরা।
জাফলংয়ের পর্যটন উন্নয়নের নামে চাঁদা নির্ধারণের পর স্থানীয় প্রশাসন জিরো পয়েন্ট এলাকার প্রবেশপথে টিকিট কাউন্টার করে। এক সময় বল্লাঘাট এলাকা হয়ে জাফলং জিরো পয়েন্টে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন বর্তমানে গুচ্ছগ্রাম হয়ে প্রবেশপথ করেছে। গুচ্ছগ্রামে বিজিবি ক্যাম্পের পাশে বসানো হয়েছে টিকিট কাউন্টার; যেখানে স্বেচ্ছাসেবকরা অবস্থান করে।
এই কাউন্টারের পাশে সাটানো সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘জাফলং পর্যটন এলাকার উন্নয়ন ও পর্যটন সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা পর্যটন কমিটি ও উপজেলা পর্যটন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যটক প্রবেশে পর্যটকপ্রতি ১০ টাকা হারে ফি নির্ধারণ করা হলো।’
এই ঘোষণার নিচে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বরাত দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে জেলা প্রশাসক জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি এবং ইউএনও উপজেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিতভাবে পাথর-বালু উত্তোলনের ফলে ধ্বংসের পথে যাওয়া জাফলংকে পর্যটন উপযোগী করার বিষয়টি মূলত ফাঁকা বুলি রয়ে গেছে।
২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে জাফলংকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হলেও তার বাস্তবায়নও হয়নি। পর্যটনের উন্নয়নে প্রবেশমূল্য নেওয়া হলেও বাস্তবে জাফলংয়ে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর ২৫ সদস্যের গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটন উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে গঠিত পর্যটন উন্নয়ন কমিটিতে পেশাজীবী সংগঠনের বিভিন্ন কমিটির ছয়জন সভাপতি প্রতিনিধি ছাড়া বাকি সবাই স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সদস্য।
সেই কমিটির তদারকিতে সাধারণত প্রতিদিন ৮-১০ স্বেচ্ছাসেবক অস্থায়ী ভিত্তিতে জাফলংয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। ঈদের সময় বা বিশেষ দিনে পর্যটকদের চাপ বাড়লে স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ২০-৩০ জনে উন্নীত করা হয়। তাদের প্রত্যেকে ঘণ্টাপ্রতি ৫০ টাকায় কাজ করলেও তাদের সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয় না বলে জানিয়েছেন ইউএনও। একজন ম্যানেজারের মাধ্যমে তাদের রিক্রুট করা এবং ঘণ্টা হিসেবে প্রতিদিনের মজুরি দেওয়া হয়। এ ছাড়া পরিছন্নতা কর্মীদের দৈনিক ৪০০ টাকা হারে মজুরি দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার বাগ্‌বিতণ্ডার পর পর্যটকদের মারধরের ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে লক্ষণ চন্দ্র দাস পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অন্য চারজন পদধারী না হলেও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। জাফলংয়ের স্থানীয় গ্রিন রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী বাবলু বখত বলেন, সরকারি বিশেষ ছুটি, শুক্র-শনিবার এবং ঈদ-পরবর্তী দিনগুলোয় প্রতিদিন লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম হয়। এ ছাড়া অন্য দিনগুলোতে জাফলংয়ে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার পর্যটকের সমাগম হয়ে থাকে। এ হিসেবে সাধারণত প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। আর বিশেষ দিনগুলোতে ১০ লাখ টাকার মতো আয় হয়।
সাধারণত স্বেচ্ছাসেবকদের মজুরি বাবদ প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে বিশেষ সময়ে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন খাত দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকা খরচের অভিযোগ রয়েছে। পর্যটন এলাকার শৌচাগার সংস্কারের জন্য প্রতিবছর পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদকে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাফলংয়ে পর্যটকদের লাঠি দিয়ে মারধরকারীদের সবার গায়ে স্বেচ্ছাসেবক লেখা জ্যাকেট দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।
তবে বাস্তবে স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই বখাটে বা ব্যবসায়ী বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। ইকবাল হোসেন নামে এক স্বেচ্ছাসেবক পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক। এ ছাড়া তার মেসার্স এসকে এন্টারপ্রাইজ নামে একটি বালু-পাথরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ইকবালের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ইকবাল হোসেন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শুধু কাজ করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘স্বেচ্ছাসেবক অর্থ কী?’ বলে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তাদের ‘প্রশাসনের লাঠিয়াল’ অভিহিত করে লেখেন, ‘হাজার হাজার মানুষের সামনে স্বেচ্ছাসেবক নামধারী লাঠিয়াল বাহিনী সিলেটের অতিথিপরায়ণতার ঐহিত্যগত সংস্কৃতিকে ধুলায় মিশিয়ে দিলো।’ তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার তারা (স্বেচ্ছাসেবক) যে আচরণ করেছে, তাতে মনে হয়েছে এরা প্রশাসনের লাঠিয়াল। চাঁদা নিয়ে যদি প্রাকৃতিক স্থানগুলো স্থানীয়ভাবে পরিচালনা করতে হয়, তাহলে পর্যটন উন্নয়নে সরকারের কাজ কী?’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘শুধু চাঁদা আদায় নয়, জাফলংয়ে খাসজমিতে প্রশাসনের মদদেই শত শত দোকান বসানো হয়েছে। এখান থেকে প্রশাসনের কর্তারা টাকা পান।’ জাফলংয়ে প্রশাসনের চাঁদাবাজির সমালোচনা করে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক ফেসবুকে প্রবেশ ফি নির্ধারণের সাইন বোর্ডের ছবিসহ দেওয়া স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘কোন আইনে চাঁদাবাজি, প্রশাসন জবাব চাই।’ আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘জাফলংয়ের ঘটনার কারণে যেটা বেরিয়ে এসেছে, সেটা হলো সারাদেশে একটু বেড়ানোর মতো সব জায়গায় প্রশাসনের মদদে ও তত্ত্বাবধানে এক নীরব চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি বলেন, ‘জাফলং পর্যটন উন্নয়নের নামে যে চাঁদা আদায় করা হয়, তাতে কী ধরনের উন্নয়ন করা হচ্ছে? পর্যটকরা কতটুকু সেবা পাচ্ছেন? টয়লেট বানানো তো জেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব। এ জন্য পর্যটকদের টাকা দিতে হবে কেন?’ তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে সিলেটসহ দেশের যে কোনো জায়গায় পর্যটন অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ সূত্র: সমকাল